Menu

ব্রিটিশ শাসনকালে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের আন্দোলনের বিবরন দাও

Last Updated on December 26, 2022 by বাংলা মাস্টার

ব্রিটিশ শাসনকালে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের আন্দোলনের বিবরন দাও

ভারতে ইংরেজ রাজত্বের ইতিহাস অনেকাংশে আদিবাসী-দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ইতিহাস।

ইতিহাস সূত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই পশ্চাদপদ আদিবাসী ও দলিত শ্রেণি কেবলমাত্র ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে লাঞ্ছিত হয়নি, সমাজের তথাকথিত উচ্চবর্ণের পাশাপাশি মধ্যস্বত্ত্বভোগী জমিদার, মহাজন শ্রেণির হাতেও নিগৃহীত হয়েছে। তবে এই সীমাহীন অত্যাচারের সবটাই তারা মুখ বুঝে মেনে নেয়নি, তাদের বিদ্রোহী রনধ্বনি বারংবার গর্জে উঠেছে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে।

ঔপনিবেশিক শাসনকালে আদিবাসী সম্প্রদায়ের আন্দোলন

চুয়াড় বিদ্রোহ

কোম্পানির অপশাসনের বিরুদ্ধে আদিবাসী-উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের প্রথম সশস্ত্র প্রতিবাদ ছিল চুয়াড় বিদ্রোহ। চুয়াররা ছিল মেদিনীপুর, বাকুড়া জেলার অন্তর্গত ‘জঙ্গলমহল’ নামক বনাঞ্চলের আদিম আধিবাসী। ব্রিটিশ-সৃষ্ট নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় অখুশি চুয়াড়, কৃষক ও জমিদাররা একযোগে বিদ্রোহ ঘোষনা করে। জগন্নাথ সিং, দুর্জন সিং, রানী শিরোমনি প্রমুখ বিভিন্ন পর্যায়ে আন্দোলনের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। ১৭৬৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় তিন দশক ধরে বিদ্রোহ চলার পর পুলিশ ও সেনাবাহিনী নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়নের মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন করে।

কোলবিদ্রোহ

বর্তমান বিহার, ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত ছোটনাগপুর, সিংভূম, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাসকারী উপজাতি জনগোষ্ঠী কোল হিসেবে পরিচিত। কোলদের বাসভূমি অঞ্চল ক্রমে ব্রিটিশের খাজনা বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হলে বহিরাগত ইজারাদারদের উচ্চ রাজস্বের চাপ এবং নির্মম অত্যাচার কোলদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। সেই সঙ্গে কোম্পানির অরণ্য আইন, কোলদের চিরাচরিত অরন্যের অধিকার কেড়ে নেয়। ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দেই তারা প্রথম সংঘবদ্ধ বিদ্রোহের সূচনা করে। বুদ্ধ ভগৎ, জোয়া ভগৎ, সুঁই মুন্ডা প্রমুখের নেতৃত্বে কোল বিদ্রোহ পরিচালিত হয়।

আরো পড়ুন :  ডিরোজিওর নব্যবঙ্গ আন্দোলনের পরিচয় দাও এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা বা ব্যর্থতা আলোচনা কর

সাঁওতাল বিদ্রোহ

মহাবিদ্রোহের পূর্বে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংঘটিত অসংখ্য কৃষক-উপজাতি বিদ্রোহগুলির মধ্যে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা ব্যাপক, বিস্তৃত তথা রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহ ছিল ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ। সাঁওতালদের বাসভূমি ‘দামিন-ই-কো’ অঞ্চলে সরকারী রাজস্বের চাপ বৃদ্ধি; সাঁওতালদের উপর জমিদার, ইজারাদার, সরকারি কর্মচারী, পুলিশ প্রভৃতির অত্যাচার ও শোষণ; বহিরাগত মহাজন ও ব্যবসায়ী কর্তৃক সহজ-সরল সাঁওতালদের বঞ্চনা ও ঋণের দায়ে জমি দখল; রেলপথ নির্মানের সঙ্গে যুক্ত ইংরেজ ঠিকাদার ও কর্মচারীদের সাঁওতাল সমাজব্যবস্থা ও সাঁওতাল রমনীদের প্রতি অমর্যাদাকর আচরন প্রভৃতি সহজ-সরল সাঁওতালদেরও বিদ্রোহী করে তোলে। সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব প্রমুখের সাহসী নেতৃত্বে বিদ্রোহ ক্রমে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত এই বিদ্রোহের ফলে ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের জন্য ‘সাঁওতাল পরগনা’ নামে একটি পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চল গঠন করে সাঁওতালদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে।

মুন্ডা বিদ্রোহ

ছোটনাগপুর মালভূমি ও সন্নিহিত অরণ্য-অধ্যুষিত অঞ্চলে ছিল ভারতের প্রাচীনতম আদিবাসী মুন্ডাদের ইংরেজ-সৃষ্ট ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় চিরাচরিত ‘খুঁৎকাঠি’ প্রথা বা জমির যৌথ মালিকানা ব্যবস্থায় ভাঙন ধরে। তাছাড়া, ছোটনাগপুর অঞ্চলে বহিরাগত ঠিকাদার, জমিদার, মহাজনদের আগমন এবং মুন্ডাদের চিরাচরিত সমাজব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ, তাদের বেগার শ্রমদানে বাধ্য করা, বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ প্রভৃতি মুন্ডাদের শেষপর্যন্ত বিদ্রোহের পথে চালিত করে। ১৮৯৯ সালে ‘স্বাধীন মুন্ডারাজ্য’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে বিদ্রোহের সূচনা হয়। মুন্ডাদের আত্মত্যাগ, স্বাধীনতাস্পৃহা এবং মরনপণ সংগ্রাম ইতিহাসের এক উজ্জ্বল ইতিবৃত্ত।

ভীল বিদ্রোহ

পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাদদেশে খান্দেশ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিম উপজাতিরা ভীল নামে পরিচিত। ব্রিটিশের শাসন, শোষণ, অত্যাচার, মহাজনী শোষণ প্রভৃতির বিরুদ্ধে ১৮১৮-১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে তারা বিদ্রোহে সামিল হয়। চিল নায়েক, শিউরাম প্রমুখ ভীলদের নেতৃত্ব দেন।

আরো পড়ুন :  বাংলার নবজাগরণ বিষয়ে বিতর্ক এবং ইতালির নবজাগরণের সঙ্গে এর তফাৎ আলোচনা কর

ঔপনিবেশিক শাসনকালে দলিত সম্প্রদায়ের আন্দোলন

মারাঠা ‘দলন’ শব্দ থেকে দলিত শব্দের উৎপত্তি, যার আক্ষরিক অর্থ পদদলিত বা অবহেলিত। ভারতীয় বর্ণ-বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থায় প্রান্তিক স্তরে অবস্থিত শোষিত, বঞ্চিত, অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী ‘দলিত’ নামে পরিচিত ছিল। সাধারণভাবে মাহার, চামার, একাবা, পুলায়া, নমঃশূদ্র প্রভৃতি জনগোষ্ঠী দলিত নামে পরিচিত ছিল।

জ্যোতিবা ফুলের নেতৃত্বে আন্দোলন

উনিশ শতকে মহারাষ্ট্রের একজন বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক ছিলেন জ্যোতিবা ফুলে। ১৮৭৩ সালে তিনি ‘সত্যশোধক সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে সমাজ সংস্কারে ব্রতী হন।

শ্রীনারায়নগুরুর নেতৃত্বে আন্দোলন

কেরালায় দলিত মানুষদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় জোরদার আন্দোলন সংগঠিত করেন এজহাবা সম্প্রদায়ের নেতা শ্রীনারায়নগুরু। ১৯২৪ সালে কেরালায় একটি হিন্দু মন্দিরে নিম্নবর্ণের মানুষের প্রবেশাধিকারের দাবিতে ভাইকম সত্যাগ্রহ’ নামে একটি সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিচালনা করে দলিত শ্রেণির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন।

আম্বেদকরের নেতৃত্বে আন্দোলন

দলিত আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন বাবাসাহেব ভীমরাও রামজী আম্বেদকর। হিন্দু সমাজের অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তিনি জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৩০ সালে তাঁর নেতৃত্বে কলারাম মন্দিরে প্রবেশের দাবীতে সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে ওঠে। স্বাধীন ভারতে তাঁর নেতৃত্বে রচিত নতুন সংবিধান অস্পৃশ্যতাকে বেআইনি বলে ঘোষণা করে।

গান্ধীজির নেতৃত্বে আন্দোলন

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধিজিও দলিত শ্রেণির আর্থ-সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে সরব হয়েছিলেন। গান্ধিজী বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে অক্ষুন্ন রেখেই অস্পৃশ্যতা দূরীকরন ও দলিত সম্প্রদায়ের কল্যানে মনোনিবেশ করেন। গান্ধিজি ‘দলিত’ শব্দের পরিবর্তে ‘হরিজন’ (ঈশ্বরের সন্তান) শব্দটি ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন।

বাংলায় দলিত আন্দোলন

দলিত আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন ছিল অবিভক্ত বাংলার-নমঃশূদ্র আন্দোলন। পূর্ববঙ্গের ছয় জেলা–যশোহর, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং ফরিদপুর ছিল নমঃশূদ্রদের আদি বাসস্থান। পেশাগত দিক থেকে নমঃশূদ্ররা ছিল মূলত কৃষিজীবি এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল কর্মের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সমাজে তারা ছিল অস্পৃশ্য।

আরো পড়ুন :  বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতি সম্বন্ধে আলোচনা কর

হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে আন্দোলন

পূর্ববঙ্গের নিপীড়িত সম্প্রদায়কে নতুন জীবন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করেন হরিচাঁদ ঠাকুর। তিনি ‘মতুয়া’ নামে একটি ধর্মীয় সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া আন্দোলন ও মতাদর্শকে আরও জোরদার করে তোলেন। পরবর্তীকালে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, বিরাটচন্দ্র মন্ডল প্রমুখের নেতৃত্বে মতুয়া আন্দোলন আরও সংগঠিত রূপ পায়।

মূল্যায়ন

সামগ্রিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিশেষে বলা যায়, আদিবাসী ও দলিত শ্রেণির আন্দোলন জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না বরং জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারাকে, অন্ত্যজ শ্রেণির এই সংগ্রাম তাদের সুদৃঢ় বাহুবলে টেনে নিয়ে গেছে বহুদুর।

দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের সুচিপত্র

দেখুন —

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!